Magic Lanthon

               

দেবাশীষ কে.রায়

প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রথম আলোর ইউনূসীয় দেশপ্রেম, উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ

দেবাশীষ কে.রায়

১.

বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় গণমাধ্যমগুলো এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমাদের জীবনে। একই সঙ্গে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অতি-গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে এই গণমাধ্যম। এ-ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রধান দুই মাধ্যম অর্থাৎ মুদ্রণ ও সম্প্রচার-কারও থেকে কেউ পিছিয়ে নেই। দুটোই প্রতিনিয়ত তাদের আধেয় নির্ধারণ করছে সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর। সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তারা নির্মাণ করে চলেছে দৈনন্দিন এজেন্ডা। কখনও এই এজেন্ডা তৈরি হয় বিদ্যমান অবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে;কখনও-বা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। নিজেদের স্বার্থ মজুদের পর তারা যা দিচ্ছে,ভোক্তা বা পাঠককুল হিসেবে গোগ্রাসে সেই আধেয়-এজেন্ডাগুলোয় আমরা চোখ রাখছি,পাঠ করছি। 

এটি স্পষ্ট যে,আজকের এই পুঁজি-প্রাধান্যশীল সমাজে বেশিরভাগ গণমাধ্যমই সমাজের পুঁজিপতিদের সৃষ্ট বা পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।আর এই সমাজ সম্পর্কে ইতালির স্বকীয় চিন্তার মার্কসবাদী পণ্ডিত অ্যান্তোনিও গ্রামসি’র চিন্তা হলো,আজকের এই পুঁজিবাদী সমাজে প্রধানত দুটি শ্রেণীর অবস্থান স্পষ্ট। এক.সাবলটার্ন বা শ্রমিকশ্রেণী। দুই.হেগেমনিক বা পুঁজির মালিক/বুর্জোয়া শ্রেণী। সামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণী কর্তৃক শাসিত হয়।আর সেই শাসন স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বয়ং গণমাধ্যমে-কখনও টেলিভিশনের স্ক্রিনে,কখনও পত্রিকার পাতায় কারও স্থান পাওয়া আর না পাওয়ার মাধ্যমে। আসলে স্থান দেওয়া না-দেওয়ার ব্যাপারটি নির্ধারণ করে দেয় গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। এই কাঠামোর মাধ্যমেই আবার গণমাধ্যম তার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করে। এ-ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে মালিকানা,মতাদর্শ,সুশীল সমাজ,বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি।

এখানে বলে রাখা দরকার যে,গণমাধ্যম সবসময় রাষ্ট্রের তথা সমাজের বিশেষ সময়ে তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে এগিয়ে চলে। আর সে-পথে ‘হালে পানি ঢালা’র মতো করে আধিপত্যশীল শ্রেণী বা ‘হেগেমনিক’ যাদের দখলে রক্ষিত থাকে সমাজের উৎপাদনের উপায়সমূহ। এবং পক্ষান্তরে তারাই মূলত সমাজের মানসিক উৎপাদনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আর অন্যপক্ষ ফলত যাদের মানসিক উৎপাদনের কোনো জায়গা নেই (থাকলেও তা অপ্রয়োগযোগ্য বা অবহেলিত)তারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেই ‘হেগেমনিক’ শ্রেণীর দ্বারা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়,গণমাধ্যম আজ ‘হেগেমনিক’ শ্রেণীর শিকলবন্দি। আর হেগেমনিক শ্রেণী-তাড়িত মাধ্যম হিসেবে ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর চৈতন্য নির্ধারণের গুরুদায়িত্বটিও তাই গণমাধ্যমগুলোর কাঁধেই এসে পড়ে।  

আর সেই সুযোগে গণমাধ্যম তার নিজ ধারায় সঞ্চার করে বিভিন্ন মতাদর্শ। ফলে এতো-এতো মতাদর্শের ভিড়ে সাধারণ জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে দমন,পীড়ন ও শোষণের উপলব্ধি। যার ধারাবাহিকতায় আমরা দৈনন্দিন প্রায় প্রতি মুহূর্তে তার অনুরণন অনুভব করি। ফলে আমাদের জীবনের অনেক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে গণমাধ্যম তাড়িত নির্দেশনা (সংবাদ,নাটক,অনুষ্ঠানমালা)মোতাবেক। বলা যায়,গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতির কবলে পড়ে জনসাধারণ আজ  মিথ্যা চৈতন্যের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে।

প্রচলিত গণমাধ্যম স্বার্থসংশ্লিষ্টতার আবরণে তার উৎপাদকে সজ্জিত করে ভোক্তার (জনসাধারণের) দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে,নির্দিষ্ট একটি ঘটনা বা সংবাদ তার চরিত্র হারিয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে মেকি কোনো পণ্যতে। সাম্প্রতিককালে মুদ্রণ মাধ্যমের এমন একটি রূপান্তরিত রূপ হলো,‘গোলটেবিল-বৈঠক’। মূলত এই গোলটেবিল বৈঠকগুলো আয়োজিত হয় নির্দিষ্ট ঘটনা (ঘটনা বলতে এখানে নিয়মিত ঘটছে বা ঘটতে পারে-এমন কোনো নির্দিষ্ট সংবাদকে বোঝানো হয়েছে) বা প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। সব ঘটনাই যেমন সংবাদ হয় না;ঠিক তেমনি সব সংবাদ,ইস্যু বা প্রেক্ষাপটেই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয় না। জনগুরুত্বপূর্ণ,বহুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা বা সংবাদগুলোকে কেন্দ্র করে আয়োজন করা হয় গোলটেবিল বৈঠকের।এসব গোলটেবিল বৈঠকের সবগুলোই যে প্রতিষ্ঠানটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ হাসিলের জন্য করে থাকে বিষয়টি তেমন নয়। কিছু জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়েও করে থাকে;তবে তা পুরো গোলটেবিল-বৈঠক পদ্ধতিকে জায়েজ করতে।

সাধারণত একটি গোলটেবিল বৈঠকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রতিনিধি (সম্পাদক,উপ-সম্পাদক) সঞ্চালক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। এছাড়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধি,আমলা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞরা এতে অংশ নেন। আলোচ্য বিষয়ের ওপর যুক্তি-তর্কের একপর্যায়ে থাকে-উদ্ভূত পরিস্থিতির স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিছু সুপারিশমালা। এখন প্রশ্ন হলো নির্দিষ্ট কোন্‌ ‘ঘটনা’ বা ‘বিষয়’, কখন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটির কাছে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেশের প্রথম শ্রেণীর দৈনিক-প্রথম আলোতে মার্চ থেকে অক্টোবর ২০১১-এ আয়োজিত সবগুলো গোলটেবিল বৈঠক মনোযোগ দিয়ে পাঠ করা হয়েছে। এরপর উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়নের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছে ড. ইউনূস,গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকটি। 

২.    

সাধারণত গণমাধ্যমের তাই উপস্থাপন করার কথা;যা ঘটে। কিন্তু তারা তা করে না। তারপরও খুব বড়ো বিপত্তি সেখানে নেই। বিপত্তির উদ্ভব তখনই যখন উপস্থাপন কৌশলের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ‘মেকানিজম’ কাজ করে। গণমাধ্যমের টিকে থাকার প্রসঙ্গে এই ‘মেকানিজম’ অতি-আবশ্যক একটি উপাদান। স্বভাবতই দিন-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতে পাঠক আশ্রয় নেয় গণমাধ্যমের। আর সে সুযোগেই গণমাধ্যম প্রসূত ধারণাগুলো অবারিতভাবে সঞ্চারিত হয়ে যায় সাধারণ ভোক্তাকুলের মনোজগতে। যেখানে গণমাধ্যমের শ্রেণী-তাড়িত মতাদর্শের ভিড়ে হারিয়ে যায় জনসাধারণের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা। আর তা থাকবারও কথা নয়। কেননা, স্বার্থের দ্বন্দ্বে,নির্দিষ্ট শ্রেণীকে বা কোনো ঘটনাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে,গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মেকানিজম প্রয়োগ করে পাতার বিশাল অংশ জুড়ে সেই সব সংবাদগুলোই প্রকাশ করে থাকে। ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় মানুষের চিন্তন প্রক্রিয়ায় কষাঘাত করে গণমাধ্যম-তাড়িত সংবাদগুলো। ফলশ্রুতিতে,মূল ঘটনা থেকে জনগণের চোখ সরানোর কাজটি সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করে গণমাধ্যম। শুধু চোখ সরিয়েই তারা ক্ষান্ত থাকে না;বরং নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে পাঠককে মুক্তচিন্তার অবকাশ না দিয়েই সে-বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা ম্যানিপুলেশনের চেষ্টা করে। আজকালকার বাস্তবতায় গণমাধ্যমই ঠিক করে দেয় কী ভাবতে হবে,কীভাবে ভাবতে হবে,অতঃপর কেনো ভাবতে হবে।

আগেই বলেছি এই লেখাটি প্রথম আলোর ‘ড.ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক’ ইস্যু নিয়ে আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠক ধরে এগোবে। নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতমূলক অবস্থান নতুন কিছু নয়।তাই ড.ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অপসারণের ঘটনাও এর ভিতরেই পড়ে। ঘটনার সূত্রপাত ২০১০ সালে নরওয়েজিয়ান একটি টেলিভিশন চ্যানেলের তথ্যচিত্র দিয়ে। যার নাম ছিলো ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে’। তাতে দেখানো হয়,১৯৯৬ সালে ড.ইউনূস নরওয়েজিয়ান এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (নোরাড)এর দেওয়া সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে তারই প্রতিষ্ঠিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণে স্থানান্তর করেছেন। তার সূত্র ধরেই গ্রামীণ ব্যাংকের নানা কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। পর্যালোচনার একপর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ড.ইউনূসের অবস্থান বাংলাদেশ ব্যাংক অবৈধ ঘোষণা করে। তারপর থেকেই এই ইস্যুটি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে তোলপাড় হতে থাকে।

গণমাধ্যম তার স্বীয় ধারায় চলতে গিয়ে অনেক সময়ই নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে এবং পরিবেশিত সংবাদগুলোর মাধ্যমে জনমত গঠনেও ব্রতী হয়।ইউনূস ইস্যুতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোও তাই করতে থাকে। প্রথম আলো-ও এর বাইরে নয়। ড.ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুটি ২০১১ সালের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিষয়টি সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংক উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার একপর্যায়ে আদালতে গড়ায়। বিষয়টি যখন আলোচনার তুঙ্গে,ঠিক তখনই একটি নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে সংবাদ পরিবেশনার দিকে প্রথম আলোর সক্রিয়তা নজর কাড়ে। প্রথম আলোর এই সক্রিয়তা তাই সংবাদের বাইরে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।

৩.

‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে’ প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে ইউনূসের বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। যেহেতু বিষয়টি একজন নোবেলজয়ী ও একটি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের,তাই এ-নিয়ে জন-আগ্রহ থাকা ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার-সংশ্লিষ্ট মহলের সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসার আগেই তা নিয়ে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে প্রথম আলো। সঙ্কট শুরু হয় মূলত এমডি হিসেবে ড.ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকে থাকা না থাকা নিয়ে। এমডি হিসেবে ড.ইউনূসের দায়িত্বপালন অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ গ্রামীণ ব্যাংককে একটি চিঠি দেয়। এবং পরবর্তী সময়ে ২ মার্চ ২০১১ ড.ইউনূসকে এই পদ থেকে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি দিয়ে আরেকটি চিঠি পাঠায়। পরদিন ৩ মার্চ ২০১১ দেশের প্রায় সব সংবাদপত্র তা প্রধান শিরোনাম করে। তারপর ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। একপর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু কোনো বিশেষ কারণে বিষয়টির সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রথম আলোর স্বার্থ-সংশ্লেষের বিষয়টি উঠে আসতে থাকে।

দেখুন,ইউনূসের বিষয়টি ছিলো একেবারে বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদিও ড.ইউনূসের জড়িত থাকার বিষয়টি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখারও অবকাশ আছে;কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এই বিষয়টিকে অন্যকোনো রাষ্ট্র কীভাবে দেখছে তাই যেনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে প্রথম আলোর কাছে। তাদের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিলো এ-রকম-‘ড.ইউনূসকে নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটনে টানাপোড়েন’।প্রতিবেদনে বলা হয়,

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড.ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে শীতলতা দেখা দেয় বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে। মার্কিন প্রশাসন ইতিমধ্যেই নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে নিয়ে করা তদন্ত ও প্রচারণার বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা সরকারকে জানিয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে,যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টির একটি সম্মানযোগ্য সমাধান চেয়েছে।

অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রভূমি যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে তাই এ-প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য। বিষয়টি যেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির একেবারেই নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপার;একই সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা তথা এর প্রতিপালনও এই রাষ্ট্রের হাতেই। তাই এর সঙ্গে জড়িত দেশের স্বার্বভৌমত্ব-স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের ঐকান্তিক গোপনীয়তা। কিন্তু তা ছাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পিছনে কারণ কী? এখন প্রশ্ন,প্রকাশের পর থেকে প্রথম আলো যেভাবে তাদের কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেম,স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব,জবাবদিহিতা,নিরপেক্ষতার কথা বলে এসেছে;কোনো সিদ্ধান্তে বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছে-সেই তারাই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অন্যের হস্তক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিষয়টি কেমন যেনো হয়ে গেলো না!তাহলে প্রথম আলো যে স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বের কথা বলে, সেটি কোন্‌ সার্বভৌমত্ব,কার স্বাধীনতা?

ক্ষুদ্রঋণ ভালো,নাকি ভালো নয়;সমাজের জন্য হিতকর নাকি ক্ষতিকর-তা যাচাই করবে রাষ্ট্রের জনগণ-সরকার-প্রশাসন।আর সবচেয়ে বড়ো কথা গ্রামীণ ব্যাংক দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে এ-দেশে কাজ করে তার প্রমাণ দিয়েছে। এমনকি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ-প্রক্রিয়ার ধরন বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছে। কিন্তু হাস্যকর বিষয় হলো,এতো বছর পর সেই ঋণ-প্রক্রিয়া নিয়ে সাফাই গাওয়ার জন্য ইউরোপিয় ইউনিয়নের নবনিযুক্ত রাষ্টদূতের প্রয়োজন পড়লো!

প্রথম আলো রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে শিরোনাম করলো-‘দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম’। প্রথম আলো কী মনে করে পাঠক কিচ্ছু বোঝে না? একথা ভুলে গেলে হবে না,এই পাঠকই প্রথম আলোকে এতোদূর এনেছে,চাইলে আবার সেই পাঠকই তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে পারে। তাই পাঠকপ্রিয়তা আছে কারণে আপনি পাঠকের ওপর এভাবে ম্যানিপুলেশন করবেন? সাধারণ জনগণের কথা না ভেবে নিজেদের স্বার্থে যা খুশি তাই করবেন? 

আরেকটি সংবাদে প্রথম আলো বলছে-‘ড.ইউনূস সরকারের আক্রোশের স্বীকার’। বিভিন্ন নাগরিক ও বিশিষ্ট পেশাজীবীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে সংবাদটি তৈরি। একই দিন অন্য দুটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক-সমকালইত্তেফাক কিন্তু এ-ধরনের কোনো সংবাদ করেনি। আগেই বলেছি যা ঘটে তাই সংবাদ হয় না,অনেক কিছুকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে সংবাদ বানানো হয়।সেই সংবাদের মেকানিজম থাকে। প্রথম আলো এবার তাই করলো,যা প্রথম আলোর প্রয়োজন। লাল কালিতে করা এই শিরোনাম দিয়ে প্রথম আলো তার হেগেমনিক শ্রেণীকে দিয়ে তার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করলো!অথচ তারা মুখে জবাবদিহিতা,বস্তুনিষ্ঠতার কথা বলতে বলতে ফেনা তুলে ফেলেছে। মানুষকে বদলানোর কথা বলে নিজেরাই অপরিবর্তিত থেকে গেছে।  

পাঠক একটু লক্ষ করুন,ঠিক যে-সময় আদালতে,সরকারের উচ্চমহলে,খোদ গ্রামীণ ব্যাংকের অভ্যন্তরে ড.ইউনূসের এমডি পদে থাকা,না-থাকা বিষয়টি আলোচিত;দেশে ক্ষুদ্রঋণের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে উৎকণ্ঠিত। ঠিক তখন প্রথম আলোর উৎকণ্ঠা চোখে পড়ার মতো। সরকারের উচ্চমহলের কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত যেনো কোনোভাবেই ‘ক্ষুদ্রঋণ’ এর গায়ে আঁচড় না লাগাতে পারে সে-জন্য তার স্বপক্ষে ‘প্রচার’ চালাতে থাকে দৈনিকটি-‘বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণের প্রসার বাড়ছে’।দেখুন সংবাদের ধারাবাহিকতা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন,তারপর দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ,তারপর সরকারের আক্রোশ,তারপর ক্ষুদ্রঋণের প্রসার বাড়ানো-সবকিছু যেনো পূর্ব-পরিকল্পিত। ইউনূসের স্বার্থে এজেন্ডা যেনো ঠিক করাই ছিলো প্রথম আলোর।সময়ে-সময়ে তা কেবল এক-এক করে বের করে দিয়েছে। বলা যায়,কোনোটিই ঘটেনি,ঘটানো হয়েছে। আর এটাই ইউনূসীয় দেশপ্রেম!

ঘটনা এখানেই শেষ নয়,ইউনূসীয় খেলা যখন শেষ পর্যায়ে,গোল যখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ;ঠিক তখন প্রথম আলো মাঠে নামলো তার পালিত সুশীল সমাজের বিশাল বহর নিয়ে। উদ্দেশ্য গোল করতেই হবে। অন্যকোনো সংবাদপত্র যখন ইউনূসকে নিয়ে প্রধান শিরোনাম করার মতো ইস্যু পাচ্ছিল না তখন প্রথম আলো করলো-‘ক্ষুদ্রঋণ সমাজে অনেক পরিবর্তন এনেছে’।ড.ইউনূস তথা ক্ষুদ্রঋণকে বৈধতা দিতে আয়োজন করা গোলটেবিল বৈঠকের ফল ছিলো এই শিরোনাম। একটু আগেই বললাম,এটা ছিলো শেষ সময় অর্থাৎ ইউনূসের এমডি পদ বহাল থাকার আদালতের রায় তখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। গোলটেবিল বৈঠকের সুপারিশকে প্রথম পাতায় শীর্ষ সংবাদ আকারে ছেপে প্রথম আলো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো জনগণের,সরকারের,নীতিনির্ধারকদের এমনকি আদালতের।

৪.

প্রতিটি গণমাধ্যমই তার প্রাতিষ্ঠানিক আন্তঃকাঠামোর মধ্য দিয়ে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে সে নির্ধারণ করে থাকে তার অবস্থান। আর তার অবস্থানই নির্ধারণ করে দেয় তার এজেন্ডা। নির্দিষ্ট এজেন্ডার মাধ্যমে পাঠকের মধ্যে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট ধারণা। এজেন্ডাভুক্ত সংবাদগুলোকে তারা পত্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছেপে তার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলতে,জনগণের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে একটুও পিছপা হলো না। বিষয়টি স্পষ্ট করতে সে-সময়ের সংবাদগুলোর ট্রিটমেন্ট লক্ষ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২ মার্চ ২০১১ তারিখে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ড.ইউনূসের থাকাকে অবৈধ ঘোষণা করে চিঠি দেয়। তার ঠিক পরদিন ৩ মার্চ প্রথম পাতায় প্রথম আলো ‘ড.ইউনূসকে অব্যাহতি দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক’ শিরোনামে তা প্রধান শিরোনাম আকারে ছাপলো। ২ মার্চ ২০১১ পত্রিকায় আপার ফোল্ডের দুই কলামের দুটো সংবাদ নজরে আসার মতো। সংবাদ দুটোর শিরোনাম ছিলো এমন-‘ড.ইউনূসকে নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপোড়েন’ এবং ‘মার্কিন দূতাবাস ও ফ্রেন্ডস অব গ্রামীণের উদ্বেগ’।অথচ ইউনূসকে নিয়ে আগের দিনে অর্থমন্ত্রীর বিদেশিদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যটি-‘এ ব্যাপারে এখনো কিছু বলার সময় আসেনি’ শিরোনামের সংবাদটি ছাপলো দুইয়ের পাতায়। আমেরিকার ‘কনসার্নে’ প্রথম আলোর এতো ‘কনসার্ন’ প্রশ্ন জাগায়।

৪ মার্চ ২০১১ পত্রিকায় ড.ইউনূস-সংক্রান্ত চারটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।এর মধ্যে ইউনূসকে নিয়ে বিভিন্ন কূটনীতিকদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ সম্মেলন নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম করলো-‘তাকে অপসারণের পেছনে কোনো আক্রোশ কাজ করেনি’।অন্যদিকে প্রথম আলো করলো-‘অসন্তুষ্ট ও বিচলিত কূটনীতিকেরা’।দুই পত্রিকার সংবাদের অবস্থান ও আকারও চোখে পড়ার মতো। যেখানে ইত্তেফাক বিষয়টিকে প্রথম পাতায় এক কলামে ছাপলো,সেখানে প্রথম আলো প্রকাশ করলো প্রথম পাতায় ইউনূসের আদালতে যাওয়ার খবরের পাশপাশি (আপার ফোল্ডে)দুই কলামজুড়ে।

ড.ইউনূসের এমডি পদে থাকা বৈধ নাকি অবৈধ সেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। বোঝাপড়া যা হওয়ার তা হবে সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের উচিত ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনের মাধ্যমে তা জনগণকে অবহিত করা। কিন্তু প্রথম আলোর ‘বস্তুনিষ্ঠতা’র সংবাদগুলো যেনো একটু ভিন্নরূপের। ৫ মার্চ ২০১১ পত্রিকায় ইউনূস সংক্রান্ত আরও সংবাদ প্রকাশিত হয়।ড.ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিয়েই তার পদে বহাল আছেন এবং সেখান থেকে তাকে অপসারণে মার্কিন সিনেটরের উদ্বেগের খবর প্রথম আলো প্রথম পাতায় ছাপে। কিন্তু একই দিনে এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য-‘এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে না’ শীর্ষক সংবাদটি ছাপা হয় দ্বিতীয় পাতায় ছোট এক কলামে। ভাবুন মোড়লরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জন কেরির বক্তব্য ম্লান করে দিলো নিজ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। এটিই প্রথম আলোর জবাবদিহিতা,বস্তুনিষ্ঠতা!

প্রথম আলো সেই সময়ে ড.ইউনূসের ইস্যুটিকে শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি বরং ক্ষুদ্রঋণের ইস্যুটিকে ঘিরে অ্যাডভোকেসিও চালিয়ে গিয়েছে। ৭ মার্চ ২০১১ প্রথম আলো শেষ পাতায় আপার-ফোল্ডে তিন কলামে ছাপলো ‘বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণের প্রসার বাড়ছে’ শীর্ষক সংবাদটি। অবাক করা বিষয় হলো,একই দিন মূলধারার আরও দুটি দৈনিক-সমকাল,ইত্তেফাক-এ এই সংক্রান্ত কোনো খবরই নেই।

৫.

সংবাদমাধ্যমগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হলেও মুনাফা বিবর্জিত প্রতিষ্ঠান নয়;সংবাদ মাধ্যমের মালিকানাই নির্ধারণ করে দেয় সংবাদনির্ভর প্রতিষ্ঠানটির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। সেই কাঠামোর কথা মাথায় রেখেই সংবাদ সংগ্রহে নামতে হয় সাংবাদিকদের;উৎপাদন করতে হয় সংবাদ,যা বণ্টন হয় জনসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ হাসিলের মাধ্যমে। যেখানে বস্তুনিষ্ঠতা স্রেফ একটি বুলিমাত্র। যেহেতু,নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে একটি সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনার ওপরই নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। সেহেতু সেই অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়ে অনেক সময়ই ধার-ধারার সময় থাকে না বস্তুনিষ্ঠতার,নীতিমালার। আর ঠিক এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কবলে পড়েই সংবাদ হয়ে ওঠে কখনও নির্দিষ্ট পক্ষের বা শ্রেণীমাধ্যমের। যেমনটি ঘটেছে প্রথম আলোর বেলায়ও।

বিষয়টি পরিষ্কার হবে এ-সংক্রান্ত কয়েকটি সংবাদ বিশ্লেষণ করলেই। ড.ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন অবৈধ সংক্রান্ত আদেশ জারি হওয়ার পর থেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। ঠিক সেই সময়েই সরকারের মুখপাত্র হিসেবে ২ মার্চ ২০১১ প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বললেন-‘এ ব্যাপারে এখনো কিছু বলার সময় আসেনি’।সংবাদে তিনি এ-ও বললেন,এটি একটি আইনি বিষয়। সত্যিই যে সংবাদ-পরিবেশন নির্দিষ্ট মাধ্যমের হতে পারে তা স্পষ্ট হয় একই সংবাদের শেষ দিকে জুড়ে দেওয়া আবদুল আউয়াল মিন্টুর একটি উক্তির মাধ্যমে। যেখানে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই সভাপতি বলেছিলেন-‘গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে সরে যাওয়ার পরামর্শ উদ্দেশ্যমূলক। সরকারের উচ্চমহলের সামপ্রতিক কথাবার্তায় সবাই বুঝতে পেরেছেন সরকার তার চরিত্র হননের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।’ কিন্তু আউয়াল মিন্টু এই কথাটি বলেছিলেন কোনো এক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া;তাও আবার অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের এক দিন আগে। অথচ প্রথম আলো অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য মোকাবেলা করতে এক দিন আগের ‘বাসি-সংবাদ’কে টেনে নিয়ে আসলো! তার মানে ‘বাসি সংবাদ’ও নির্দিষ্ট মাধ্যমের,শ্রেণীর জন্য ‘টাট্‌কা’ হয়ে উঠলো!আর টাটকা সংবাদ দিয়ে প্রথম আলো বুঝিয়ে দিলো গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে তারা কীভাবে দেখছে।

৪ মার্চ ২০১১ এবার ‘অসন্তুষ্ট ও বিচলিত কূটনীতিকেরা’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করলো প্রথম আলো। আগেই সংবাদটির শিরোনামের পক্ষপাত নিয়ে কথা বলেছি। এবার একটু সংবাদটির ভিতরে ঢুকি। সংবাদে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে এভাবে,‘গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে ড.ইউনূসের অবস্থান অবৈধ।’ সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনের একপর্যায়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে এক রিপোর্টারের প্রশ্ন ছিলো-‘এতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কোনো অবনতি ঘটবে কি? উত্তরে মরিয়ার্টি বলেন,‘আমি তা জানি না’।কিন্তু পরদিন প্রথম আলো এ-কথার ব্যাখ্যা নিজের মতো ম্যানিপুলেট করে ছাপলেন,‘কূটনীতিকরা বিচলিত অসন্তুষ্ট’।এখন আপনারাই বলুন ‘আমি তা জানি না’-এর মানে যদি বিচলিত,অসন্তুষ্ট হয়; তাহলে আর বলার কী-ই বা আছে! তখন প্রথম আলোর এক যুগের গানকে একটু পাল্টিয়ে বলতেই হয়,‘সব কিছু বদলে ফেলুন নিজের মতো করে’।অবস্থা দেখে মনে হয়েছে,প্রথম আলো যেনো ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষ্যাপানোর জন্য নিজেরাই ক্ষেপে গেছে। তাদের আচরণে পাগলকে নৌকা ঝাঁকানোর কথা স্মরণ করে দেওয়ার গল্প মনে পড়ে গেলো। অত্যন্ত দেশপ্রেমিক প্রথম আলো এই সংবাদ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে তাদের সার্বভৌমত্বকে আরও জোরালো করার চেষ্টা করলো মনে হয়!

একই দিনে (৪ মার্চ ২০১১)পত্রিকাটির প্রধান শিরোনাম ছিলো-‘আদালতে গেলেন ড.ইউনূস’। তাতে বলা হয়,গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অব্যাহতি প্রদানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিনি এবং তার ব্যাংকের নয় পরিচালক পৃথক দুটি রিট আবেদন করেন। (ইউনূসের) আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন,গ্রামীণ ব্যাংকের বিধিমালা মেনেই ড.ইউনূস পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমেই এমডি পদে বহাল আছেন। এবং এই বিধিটি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুমোদনের কথাও বলেন তিনি।

কিন্তু সরকার পক্ষের হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্‌বুবে আলম বলেন,‘এই অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে দেয়নি। ৬০ বছর বয়স হলে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি চাকরিতে থাকতে পারে না। তিনি ৭০ বছর বয়সে এসেও স্বপদে বহাল আছেন। যা বিধিবহির্ভূত।’ ১৯৮৩ সালে ড.ইউনূসকে প্রথমবারের মতো এবং ১৯৯০ সালে তাকে দ্বিতীয় দফায় এমডি নিয়োগ করে গ্রামীণ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে তিনি চলে যেতে চাইলেও ব্যাংক তাকে যেতে দেয়নি। এই সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের অনুমোদন দিয়ে গেজেট প্রকাশের কথা ছিলো বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তা দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে, গ্রামীণ ব্যাংক নিজে থেকেই সেই গেজেট বিজি প্রেস থেকে ছাপিয়ে নেয়।

সংবাদটিতে একটি বিষয় লক্ষণীয়,(কেউ চাইলে সংবাদটি পড়ে দেখতে পারেন, অনলাইনে প্রথম আলো আর্কাইভে এসব সংবাদ যত্ন-সহকারে সাজিয়ে রাখে)পুরো সংবাদ জুড়ে ড.ইউনূসের আইনজীবী ড.কামাল হোসেনের বক্তব্য যেভাবে যতোবার উঠে এসেছে,অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্‌বুবে আলমের বক্তব্যকে সেভাবে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। বিষয়টি এমন-হাতে তরবারি না দিয়ে মাহ্‌বুবে আলমকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো। তো,এতে পাঠক উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই,কারণ এটিই ‘প্রথম আলো-ইও’ বস্তুনিষ্ঠতা।

‘আইনি লড়াইয়ে থাকছেন ইউনূস’ শিরোনামে ৯ মার্চ ২০১১ আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করলো প্রথম আলো। প্রতিবেদনে বলা হয়,২ মার্চ ড. ইউনূসের এমডি পদে থাকাকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাহী সংক্রান্ত গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৪ (১)ধারা মোতাবেক ড. ইউনূসের এমডি পদে থাকা বৈধ নয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে গ্রামীণ ব্যাংকের করা দুটি রিট আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। সেখানে বলা হয়,ব্যাংক কোম্পানি আইনের ধারা মোতাবেক যেকোনো ব্যাংকের ওপর ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আছে। তাই সে-সময় গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তথা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। তাই রিট দুটি খারিজ করা হলো।

সংবাদটির একেবারে শেষ দিকে শুনানির অংশবিশেষে বলা হয়,রিটের আবেদনকারীরা বলছেন,ড.ইউনূসের নিয়োগের ব্যাপারে পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়নি,বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন বক্তব্য সঠিক নয়।১৯৯০ সালে তিনি নিয়োগ পেলেও পরবর্তী সময়ে আইন ঠিকই সংশোধিত হয়।কিন্তু তাকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে ওই অনুমোদন বহাল আছে। ৬০ বছর বয়সের বিধান ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কেননা তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। আর এ-সংক্রান্ত বিধান হয়েছে ১৯৯৩ সালে। এখন প্রশ্ন হলো,যে ব্যাংক (গ্রামীণ ব্যাংক) এতো এতো আইনের কথা বলছে অথচ তারাই ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারা মানছেন না। মজার ব্যাপার হলো প্রথম আলো ওই প্রতিবেদনে এতো কথা বললেও এই ধারা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য কিন্তু তুলে ধরেনি। হায় সেলুকাস! ড. ইউনূসের জন্য ‘মহা-নীতিবান’ প্রথম আলোর এই হলো ‘ভালো’র পক্ষে থাকা।  

এই প্রতিবেদনের আগের দিন (৮ মার্চ) ড.ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক আদালতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশের বৈধতা নিয়ে রিট আবেদন করার একটি সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো। সংবাদের ভাষ্যমতে,মামলার শুনানিতে ড.ইউনূসের পক্ষের আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহ্‌মুদ বলেন,‘১৯৯০ সালে নিয়োগ পাবার পর পরবর্তীতে বিধি পরিবর্তন করে গ্রামীণ ব্যাংক। সে অনুযায়ী তিনি যত দিন ইচ্ছা সে পদে থাকতে পারবেন। ফলে এটা নতুন নিয়োগ নয়,ধারাবাহিকতা। তাই পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই।’ এ-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আরও আলোচনা ছিলো ওই সংবাদে। তার আশপাশে না গিয়ে প্রথম আলো এই সংবাদবিবরণীর শিরোনাম করলো এভাবে-‘এরপর কেউ নোবেল পেলে হয়তো দেশেই আসবেন না’।

একটু লক্ষ করলে বুঝতে কষ্ট হয় না,শিরোনাম ও সংবাদের গঠন পুরোটাই নির্দিষ্ট শ্রেণী-তাড়িত। কারণ,একই দিনে একই বিষয়ের সংবাদের শিরোনাম সমকাল করেছিলো এভাবে-‘ইউনূসের রিটের শুনানি শেষ,আজ আদেশ’।আর ইত্তেফাক-এ বিষয়টি এসেছিলো-‘রিটে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে ব্যারিস্টার রোকনের আশঙ্কা’। দেখুন পাঠক, প্রাতিষ্ঠানিক স্বর্থের কবলে পড়ে কীভাবে একটি সংবাদ তার রকমারি অবয়ব ধারণ করতে পারে।

৬.

সমাজে আধিপত্যশীলদের ভূমিকা ছিলো,থাকবে-ইতিহাস এমনটাই বলে। বর্তমানের গণমাধ্যম নামক অদ্ভুত উটকে পরিচালনা করছে এই আধিপত্যশীল জোতদাররাই। যার প্রভাবে সেই হেগেমনিক শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত থাকে সমাজ পরিচালনার ভার। আর সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তে তাদের পরিকল্পনাগুলো আরও পুষ্ট হয় ক্রমাগত। তারই উদাহরণ প্রথম আলোর মতো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান।

যে-ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে প্রথম আলোর এতো মাতামাতি,সে-সম্পর্কে কিছু না বললে আলোচনার এই পর্যায়টি জায়েজ হবে না। মূলত ক্ষুদ্রঋণ প্রক্রিয়াটি যাদের ওপর ক্রিয়াশীল তারা পূর্বোল্লিখিত সেই সাবলটার্ন শ্রেণী। এই শোষিত গোষ্ঠীকে আরও শোষণের আধুনিকতম প্রচেষ্টা হলো ‘ক্ষুদ্রঋণ’।যাতে ভূমিহীন গরিব জনগোষ্ঠীকে ঋণ দিয়ে তাদের ভাগ্যন্নোয়নের কথা বলা হচ্ছে। মূলত, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার এক অভিনব প্রয়াস হলো ‘ক্ষুদ্রঋণ’ পদ্ধতি।

গ্রামীণ ব্যাংক দাবী করে তাদের ৯৩ শতাংশ সদস্য (তাদের ভাষায় অবশ্য মালিক) ভূমিহীন নারী। আর এখানেই গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবসা। এই নারীদের সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করা যতোটা সহজ অন্যভাবে সেটা ততোটা সহজ নয়। তাছাড়া সুদে টাকা খাটিয়ে মুনাফার জন্য কারখানা স্থাপন,উৎপাদিত পণ্য নিয়ে হাঙ্গামা পোহানোরও কিছু নেই,শ্রমিকদের সঙ্গে দর কষাকষি ইত্যাদির কোনো দরকার হয় না। ঋণগ্রহীতা নারীরা কঠিন শর্তে (প্রায় ২০ শতাংশ সুদে)ঋণ নিয়ে একধরনের ভূমিদাসের মতোই ড.ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করেন। অথচ ড.ইউনূস তার বানানো নব্য এই দাসদের নিয়ে ব্যবসা করে নতুন নাম দেন সামাজিক ব্যবসা।

বিশ্বায়নের প্রভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে অর্থনীতি প্রপঞ্চটি। নাম হয়েছে তার মুক্তবাজার-অর্থনীতি।যা মূলত উদার বাণিজ্যনীতি। বাণিজ্যের এই উদারতায় সব দেশের বড়ো ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে ফুলে উঠছে। আর দরিদ্ররা থেকে গেছে সেই অনতিক্রম্য অন্ধকারে। বিশ্বায়নের প্রভাবে গোটা বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হলেও বিশ্বে কমেনি ক্ষুধার্ত-দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা। তাই যেকোনো সময় এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হতে পারে। এছাড়াও বিংশ শতাব্দীর মাথাচাড়া দেওয়া নারীবাদ একবিংশ শতাব্দীতে অগ্রসর ও বিপ্লবাত্মক আন্দোলনে রূপ নেওয়ারও ভয় আছে।তাই বিশ্ব-নেতাদের তখন প্রয়োজন হচ্ছিলো এমন এক তত্ত্বের যা প্রয়োগ করলে দারিদ্র বিমোচন হবে না;আবার দরিদ্ররা ক্ষুধাতেও মারা পড়বে না। সে-ক্ষেত্রে তাদের বিপ্লব থেকে দূরে রাখতে পারে নগদ ঋণ। আর যে-টাকা ঋণ হিসেবে যাবে তা ফিরে আসবে লাভসহ। সাম্রাজ্যবাদীদের সেই চাওয়াটুকু পূরণ করেছিলো ড.ইউনূসের উদ্ভাবিত অমোঘ তত্ত্ব ক্ষুদ্রঋণ। এবার নারীবাদ ঠেকানোর পথেও তা শামিল হলো। ক্ষুদ্রঋণের পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো নারী উন্নয়নের সিলমোহর। আর যায় কোথায়! বৈশ্বিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকলো গ্রামীণ ব্যাংকের মতো রক্তচোষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখা। মূলত পৃথিবীর তাবৎ বণিক গোষ্ঠীর মনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছেন ড. ইউনূস। তারই বদৌলতে বাংলার ঘরে এলো নোবেল। বস্তুত,ক্ষুদ্রঋণকে বিশ্বব্যাপি ‘মহৎ আদর্শ’ হিসেবে প্রচারের জন্য এটি খুব জরুরি ছিলো।

গ্রামীণ ব্যাংক সংক্রান্ত আর একটি গা শিউরে ওঠা তথ্য দিয়ে এই পর্বের আলোচনা শেষ করছি। বাংলাদেশের টেলিকম খাতের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন। নামটি শুনতে বাংলা-বাংলা হলেও এটি কিন্তু বাংলার নয়। এর মূল প্রতিষ্ঠানটি নরওয়ের; যার নাম টেলিনর। বাংলাদেশে এ-প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করছে গ্রামীণফোন নামে। অনেকেই হয়তো জানেন না,টেলিনরকে বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে ড. ইউনূসের প্রচ্ছন্ন হাত ছিলো। ১৯৯৬ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গ্রামীণফোন কনসোর্টিয়াম এর পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন ড.ইউনূস। যে-কনসোর্টিয়াম গঠিত হয়েছিলো টেলিনর,গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম,মারুবেনি ও গণফোনকে নিয়ে। ৫০ টাকার স্ট্যাম্পের উপরে করা সেই চুক্তি অনুসারে বার্ষিক মাত্র এক কোটি টাকার অপারেটিং লাইসেন্স ফির বিনিময়ে গ্রামীণফোন তথা টেলিনরকে বাংলাদেশে ব্যবসার অনুমতি পাইয়ে দেন ড.ইউনূস। গ্রামীণফোনের পুরো শেয়ারে টেলিনর ৫১ শতাংশ, গ্রামীণ টেলিকম ৩৫ শতাংশ এবং মারুবেনি ও গণফোন মিলে ১৪ শতাংশ ভাগ করে নিয়েছিলো।

টেলিনর বাংলাদেশে ঢোকার সময় কথা ছিল ২০০৮ সালের মধ্যে গ্রামীণফোনের বেশির ভাগ শেয়ার গ্রামীণ টেলিকম তথা গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া হবে। কিন্তু পরে টেলিনর সে-কথা রাখেনি। ২০০৪ সালে সর্বশেষ গ্রামীণ ফোনের মালিকানা নিয়ে আলোচনা হয়।তখন টেলিনর গ্রামীণফোনের তৃতীয় অংশীদারের পুরোটা এবং চতুর্থ অংশীদারের বেশিরভাগ শেয়ার কিনে নেন। ফলে তাদের শেয়ার শুরুর ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়।সে-সময় গ্রামীণ টেলিকম মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার কিনতে পেরেছিলো। ফলে তাদের শেয়ার ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৮ শতাংশ হয়।ফলে গ্রামীণফোনের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় টেলিনর। তারা অপারেটরের নাম গ্রামীণফোন রাখলেও এর লোগো পরিবর্তন করে ফেলে।

পাঠক এখানে একটা বিষয় খেয়াল করুন,এই টেলিনর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে একই চুক্তি করে ১৮ হাজার কোটি টাকায়। অন্যদিকে,যে চুক্তি আমাদের দেশপ্রেমিক ইউনূস দেশের মালিকানায় থাকার ধোঁয়া তুলে করেছিলেন এক কোটি টাকায়। বিষয়টি একবার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন,কোথায় এক কোটি আর কোথায় ১৮ হাজার কোটি। ইউনূস সেটি করালেন ভালো কথা;আমাদের বোঝালেন এর মালিকানা এক সময় আমাদের হবে,তাই এক কোটি কী আর এক হাজার কোটি কী? আমরা মহানন্দে আমাদের রেলওয়ের শক্তিশালী টেলিফোন ব্যবস্থাকে তাদের ব্যবহার করতে দিলাম। তারা ধীর ধীরে পুরো দেশে অবকাঠামো গড়ে তুললো। তারপরই গ্রামীণফোনকে পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো টেলিনর। ২০০৮ পর্যন্ত টেলিনরের সইলো না, ২০০৪-এ গিয়েই তারা গ্রামীণফোনের প্রায় পুরো মালিকানা হস্তগত করে নিলো। আর করবে নাই বা কেনো,২০০৫ সালে বাংলাদেশে গ্রামীণফোনের নিট মুনাফা ছিলো ১০ হাজার কোটি টাকা। যার থেকে টেলিনর পেয়েছিলো সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। এতো টাকার লোভ কী আর সামলানো সম্ভব!তখন আমাদের বুদ্ধিমান দেশপ্রেমিক ইউনূস বিবৃতি দিলেন, তিনি দেশের টাকা দেশে রাখতে চান, অথচ টেলিনর তার কথা রাখছে না। তিনি বললেন, টেলিনরের সঙ্গে তাদের এই চুক্তি ছিলো নাকি মৌখিক, তাই তারা কিছু করতে পারছেন না। এ-কথাগুলো ইউনূস বললেন কখন,যখন ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের অসলোতে নোবেল পুরস্কার আনতে যাবেন তার মাত্র কয়েকদিন আগে।

ভাবুন,ইউনূসের মতো এতো বড়ো একজন অর্থনীতিবিদ টেলিনরের মতো এতো বড়ো একটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করলেন মৌখিকভাবে। ভাগ্য ভালো যে তিনি বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিটিও মৌখিক করেননি। আর করলেও খুব বেশি সমস্যা হতো না, কারণ ১৮ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে এক কোটি টাকা কিছুই না। এ-টাকা বাংলাদেশ সরকার পেলেই কী আর না পেলেই কী? কিন্তু দেশ কিছু পাক বা না-পাক ‘দেশপ্রেমিক’ ইউনূস কি পেয়েছেন তা আপনারা সবাই জানেন-নোবেল। যা আনতে তাকে সেই নরওয়েতেই যেতে হয়েছিলো। এখন ইউনূস যদি মনে করেন জনগণ কিছুই বোঝে না, তাহলে ভুল করবেন। সেই ভুল অবশ্য এখন প্রথম আলোও করছে, ‘ইউনূসীয় দেশপ্রেম’ দেখাচ্ছে।

৭.

পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষা কঠিন। উচিত আর অনুচিতের দ্বন্দ্বও আপেক্ষিক। তারপরও আমরা কেনো জানি আজ কেমন হয়ে গেছি,‘বাজার’ আমাদের মেধা-মনন নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মেধা-মননের দৃষ্টি কেনো জানি শুধু ওই শ্রমজীবী মানুষগুলোর দিকে। ভালো-ভালো কথা বলে,আমরা সবকিছু তাদের লুটে নিচ্ছি; বিপরীতে শুধু তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখছি বিন্দু পানি দিয়ে। আর বেঁচে থাকাটাকে যারা মুখে নয়,মনে সমর্থন করে-তাদের প্রথম সারিতে রয়েছে প্রথম আলো ও আমাদের ‘গর্ব’ ড.ইউনূসরা।

লেখক :দেবাশীষ কে.রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।

shish07ru@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১.চট্টপাধ্যায়,পার্থ (এপ্রিল ২০০০);‘ক্ষমতা প্রসঙ্গে দুই প্রেক্ষিত :গ্রামশি ও মিশেল ফুকো’;ইতিহাসের উত্তরাধিকার;আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা।

২.সাধারণত সংবাদপত্রের পাতার উপরের অংশকে ‘আপার ফোল্ড’ হিসেবে ধরা হয়;বিপরীতে নিচের অংশকে বলা হয় ‘লোয়ার ফোল্ড’।

৩.উমর,বদরুদ্দিন (১৯৯৫ : ১১১); ‘গ্রামীণ ব্যাংক :একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্র’;সাম্রাজ্যবাদের নোতুন বিশ্বব্যবস্থা;জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা।

৪.রনো,লুৎফর রহমান; ‘ক্ষুদ্রঋণের ঘূর্ণি শ্রম শোষণের নির্ভেজাল প্রকল্প’;মত পথ; সম্পাদনা-র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী;বর্ষ-২; সংখ্যা-১৪, মার্চ-২০১১, পৃ:৩৮-৩৯, গুলশান, ঢাকা।

৫.২০০৬ সালে শফিক রেহমান সম্পাদিত দৈনিক যায়যায়দিন থেকে তথ্যগুলো নেওয়া। পত্রিকার ওই সংবাদটির কাটিং লেখকের কাছে থাকলেও ভুলবশত তিনি তারিখটি টুকে রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। কেউ চাইলে লেখক তাকে এটি সরবরাহ করতে রাজি আছেন। 


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ের ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন